এটি কোন গল্প নয়, কিংবা নয় কোন বিখ্যাত উপন্যাসের কোন ট্রাজেডি অংশ অথবা এমনও নয় বিখ্যাত লেখকের কোন কালজয়ী উদ্ধৃতি, উপমা বা কাল্পনিক চিত্রায়ন। এটি একটি সাদা কাগজ। সাদা কাগজের উপর একটি কালো কালির কলম কয় ফোটা রক্তিম তরল ফেলে ফেলে চিত্রিত করছে ভাব, জীবনের গতি আর কয়েকবার খস খস শব্দ মাত্র। ব্যস এতোটুকুই। কলমের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার ক্ষমতা কলম ধারকের নেই বললে অত্যুক্তি করা হয় না। ঠিক সীমাহীন নদীতে চলমান পানির নিম্মগামীতার মতো। কলম যেন খস খস শব্দ তুলে এগিয়ে চলছে আর যার হাতে কলম সে নির্বিকার, চোখের ভাষায় উদাসীনতা, কোথায়ও হারিয়ে যাবার এক অকাল্পনীক চিত্রায়ন।
আব্দুল বাছেত মিয়া। সে বসতে চায়নি সাদা কাগজ নিয়ে কিন্তু কলম তাকে টেনে এনে বসিয়েছে বেলকোনীর অস্পষ্ট আলোতে। অদূরে একটি ল্যাম্পপোস্টের আশে পাশে সামান্য আলোর ছোয়া আর গোটা অঞ্চলটা নিকষ কালো অন্ধকার। কয়েকটি প্রশ্ন তার জীবনের সামনে দন্ডায়মান। সহজতর উত্তর অবিশ্বাস্য আর কঠিনতর উত্তর কয়েকটি জীবনের পাতায় ছন্দের পরিবর্তক। তার দৃষ্টি কাগজের উপর আছে কিনা বলা মুস্কিল তবে কলম যে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে কয়েকটি অর্থবোধক বাক্য তৈরি করছে তা নিতান্তই অসত্য নয়।
নভেম্বরের একটি তারিখ। এই মাত্র গোসল সেরে বসেছে কয়েকজন ভাবী, নানী, দাদীর মধ্যেমণি হয়ে। চারদিকে খিলখিল্য হাঁসির রোল। দুই হাতে মেহেদীর আঁকিবুঁকি। বাড়ির পাশে রাস্তায় গাড়ির শব্দ আর বুকে মৃদু কাঁপন, অজানাকে আলিঙ্গনের মধুরতম কষ্ট আর সহনীয় ভয়।
আত্মীয় স্বজনদের হাস্যরসদ্দীপক বাক্যালাপ আর অনগ্রসর ব্যস্তবতার মাঝেই এক সময় উপস্থিত হল আব্দুল বাছেত মিয়ার হবু শশুড়ালয়ে। গুটিকয়েক নিয়ম-কানুন আর তিনটি শব্দের অস্পষ্ট কাঁপা কাঁপা উচ্চারণ গেঁথে দিল দুটি হৃদয়ের একটি অদৃশ্য বিনে সুতোর মালা। অপরিচিত এবং এ পর্যন্ত অদেখা দুটি ভয়যুক্ত মনের চাহনী আকাঙ্খিত। উভয় পক্ষের অভিভাবকের মতের বিয়েতে দুজন দুজনকে না দেখলেও সম্মত হবার বিষয়টি বর্তমান সময়ে দুষ্প্রাপ্য বস্তু। মেয়েদের প্রাকৃতিক ও সৃষ্টিগত কয়টি ছকবাঁধা নিয়মের পাল¬ায় পড়ে তাকে শুণ্য হাতে-মুখে ফিরতে হয়েছে নিজ গৃহে।
স্ত্রীহীন সারা রাত্রী এপাশ ওপাশ করে কাটাতে গিয়ে দেরিতে ঘুম আসে বিধায় পরের দিন সকাল দশটা অবধি তার ঘুম ভাঙ্গেনা। ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতি নিয়ে রাস্তায় বের হল। সাথী হিসাবে শুধু শখের মোবাইলটি। নববধুর সাথে কথা বলবে কিন্তু কিভাবে তা মনস্থির করতে অক্ষম হয়ে মোবাইলের নম্বর বোতাম চাপছে আবার কল কেটে দিচ্ছে। এক সময় অস্থিরতার উপর জয় হল আকাঙ্খার, সেই সাথে প্রবল স্থিরতার। তবু বুকের দুরু দুরু কাঁপন কমেনি। কল রিসিভের স্পষ্ট নিদর্শন পেয়ে কানের কাছে সেট নিয়ে দ্রুত বলল, ‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম, আমি হাসিকে চাচ্ছি।’ ওপাড় থেকে সালামের উত্তর ভেসে এল। তবে কন্ঠটি ছেলের না মেয়ের তা পার্থক্য করা সম্ভব হচ্ছিলনা বিধায় শেষের বাক্যটি পুনর্বার উচ্চারণ করতে হল। কন্ঠ ভেসে এল,‘আপনি কে বলছেন?’
‘আমি বাছেত, আব্দুল বাছেত মিয়া’।
ও! ক্যামন আছ? আমিই হাসি।
আমি ভালো আছি।
দু’চারটি ফরমাল কথার পর তাদের বাক্যালাপ বেশি দূর এগোয়নি। হাসি তাকে জানালো, ‘অধৈর্য হইওনা চার দিন পর তুমি আসবে এই ভয়ে মনটা কাঁপছে। এখন অযথা কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি? কি যেন হয়, কি যেন হয়, এই ভয় চিরক্ষণের সাথী।
নির্দিষ্ট দিনে যথা সময়ে বাসর ঘরের দিকে এগুলো আব্দুল বাছেত মিয়া। পড়নে তার পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি। রুমে ঢুকেই সে আশ্চর্য না হয়ে পারেনি। লাল শাড়ীর বদলে পড়েছে সবুজাভ ও গোলাপী রং মিশ্রিত রঙের শাড়ী। বাছেত মিয়া সিনেমায় দেখেছে, উপন্যাসে পড়েছে এবং বন্ধুদের কাছে শুনেছে বাসর ঘরে নতুন বউ স্বামীর দেয়া লাল টুকটুকে শাড়ী পড়ে বসে থাকে। এজন্য সে ঢাকা থেকে একটা পছন্দ করা শাড়ী দশ হাজার সাতশত টাকা দিয়ে কিনে এনে দিয়েছিল। সে ভেবেছিল সেই শাড়ীতে তার মানস প্রিয়ার সাথে তার প্রথম সাক্ষাত হবে। রাঙা ঠোঁটের মৃদু কাঁপন আর লজ্জা মিশ্রিত চোখের চাহনী হবে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্বল। জীবনের প্রথম ধাপে একটা বড় ধরনের হোঁচট খেলেও স্মিত হাঁসিসহ সালাম দিল বাছেত মিয়া।
বিছানা থেকে উঠে এসে সালাম নিয়ে বলল, ‘মনে কিছু কর না, এটি আমার এক বন্ধুর দেয়া উপহার। বন্ধুর মনে কষ্ট দিতে চাইনি। পি¬জ রাগ কর না, তুমি আমার স্বামী, বিষয়টা তুমি ছাড়া অন্য কেউ ভালো বুঝবে না। তাছাড়া গোটা জীবনতো তোমার জন্যই। আমি স্পষ্টতায় বিশ্বাসী তাই গার্জিয়ান দিয়ে তোমাকে জানিয়েছি, বন্ধুটিকে আমি ভালবাসতাম। আমাদের ভালবাসাকে তার পরিবার না মানাতে তোমাকে না দেখেই মেনে নিয়েছি। তোমার গার্জিয়ানদের জানানো হয়েছে, তুমি এসব জেনেই বিয়েতে রাজী আছ জেনে আমি খুব খুশি’।
মৃদু স্বরের কথাগুলোকে কাব্যিক ভঙ্গিতে তুলে ধরার কারণে মনে মনে ধন্যবাদ দিল বাছেত মিয়া এবং ভাবল মনো-আকাঙ্খার প্রতিফলন না ঘটলেও সমলাইনের কাব্য মানস এক স্ত্রী পাওয়া কম ভাগ্যের ব্যাপার নয়। অবশ্য হাসির পূর্ব প্রেমের ব্যাপারে সে পুরোপুরিই অন্ধকারে। কারো কারো ভাগ্য বোধহয় বিধাতা নিজ হাতে গড়েন না। বাসর ঘরে স্ত্রীকে স্পর্শ করার পূর্বেই কয়েকটি শর্তের বেড়াজালে আটকা পড়ে সে। সে তার বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে আগের মতোই মিশবে, সন্তান নেবার সিদ্ধান্ত শুধু সেই নিবে, বাবা মা হতে পৃথক হতে হবে, সব ক্ষেত্রে স্ত্রীর সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে, যতদিন পর্যন্ত বাছেতের চাকরি না হবে ততদিন হাসি শশুড় বাড়ি যাবে না, বাছেতের ছোট বড় ভাই বোন কোন ধরনের কাজ করতে বলতে পারবে না ইত্যাদি। দুই একটি শর্ত মেনে নেবার মতো মনে হলেও বিশেষত একমাত্র ছেলে হিসাবে বাবা-মাকে ত্যাগ করা, পূর্ণ যৌবনে স্ত্রীর কথায় ওঠা বসা কিছুতেই মানতে পারেনি বাছেত মিয়া। তাছাড়া ভাই বোনদের সাথে অন্তর্দ্বন্দ্বের স্রস্টা হিসাবে স্ত্রীকে মনে হয়েছে। তাই জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্ছিত দিনে বিনিদ্র রজনী কাটানো তার জন্য পাহাড়সম কষ্ট হয়ে তার বুকে বিধে। কষ্ট সৃষ্টে আর একদিন শশুড়বাড়ী কাটিয়ে শুণ্য হৃদয়ে বাড়ীতে ফিরতে হয় তাকে।
বাছেত মিয়া ভেবেছিল একদিন না একদিন হাসির আচরণ বদলে যাবে কিন্তু তা হয়নি। তাদের দুজনের মধ্যেকার কথাগুলো থেমে থাকেনি। এক কান দুই কান করতে করতে রাস্তার মতো অসীমতায় রূপ নিতে যাচ্ছিল। এমনি এক পরিবেশে বাছেত মিয়া দাওয়াত পায় তার মামা শশুড়ালয়ে। স্বামী স্ত্রীর মতের অমিল সত্ত্বেও সে বাড়িতে হেঁসে খেলে দিনটি শেষ করতে হয়। তবে রাত্রে এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয় সে। মামাশশুড়ও হাসির সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘বাবা মা হতে পৃথক হলে সমস্যা কি? আমাদের মেয়ের বেতন আছে। তুমি বেকার ছাত্র তাতেও সমস্যা নেই। তোমার বাবা-মা’র সম্পদটা দেখেই তো বিয়েটা দিলাম, নইলে একটা বেকার ছাত্রের হাতে একটা চাকুরীজীবি মেয়েকে কেউ তুলে দেয়? সব ভালো মন্দের ভার হাসির উপর ছেড়ে দাও। দেখনা আমি তোমার মামীকে নিয়ে পৃথক হয়ে কত সুখে আছি। বাবা-মা’কে মাঝে মাঝে খরচ দিচ্ছি, বৃদ্ধ বয়সে তারা আর কতই খায় বলো?’ বলে হাঁসলেন বাছেতের মামাশশুড়। সে রাতও বিভাজন সূত্রে বাঁধা ছিল। ফিরে আসতে হয় শুণ্যতা নিয়ে।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। হাসি কোথায়ও থেকে জানতে পারে বাছেত মিয়ার একটা পছন্দের মেয়ে আছে। বাছেত মিয়া আরও শুনে সেই উপহার দেয়া যুবকের সাথে আজও হাসির অন্তরঙ্গতার কথা। আরও যে কয়টি কথা বাছেত মিয়া বেশি শুনে তা হল স্ত্রী এবং শাশুড়ী উভয়েরই পছন্দ নয় বাছেতকে। অবশ্য কারণটা বর্ণ! শুরু হয় উভয় পক্ষের মানসিক দরকষাকষি। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর শর্ত, শাশুড়ী কর্তৃক জামাইয়ের অনাদর ইত্যাদি ডেকে নিয়ে যায় একটি সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে। পারিবারিক মিটিং (সালিশ) শেষে সিদ্ধান্ত হয় মেয়েটি পরে তার সিদ্ধান্ত জানাবে বাই পোস্ট হোক তা কোর্টের মাধ্যমে অথবা স্বহস্তে।
দিনের আলো নিভে যায়, রাতের চাঁদ জোৎস্না ছড়ায়। আবার চাঁদ লুকোয় দিনের আঁচলে। এভাবে কেটে যায় কয়েকটি মাস। অবশেষে সামনে আসে একটি ‘খাম’।
পরিশিষ্ট
বহুদিন চলে যায় খামটি খোলা হয়নি। বাছেত মিয়ার ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় কেনা বাক্সে শোভা পাচ্ছে স্বযতনে। মাঝে মাঝে মনে হলে নিজেই একটু ক্লান্ত হাঁসিটি হাঁসে। এই হাসি নামটি বা শব্দটি তার জীবনের প্রথম উপহার। তাই প্রতিজ্ঞ সে, এ বিশেষ্য বা বিশেষণটিকে আজীবন আগলে রাখবে। কিন্তু বাছেতের পরিচয় এখন কি? বিবাহিত, বিপত্মীক ———। সব প্রশ্নের উত্তর ঐ একটা খামের ভিতরে।
গল্পের অপ্রয়োজনীয় অংশ
কষ্টের সাগরে কোন সাথী না পাওয়ায় বাছেতের জীবন খুব আনন্দে (!) কাটে শুধু রাতের একাকিত্ব ছাড়া। তিনটি শব্দের উচ্চারণ কি ডাস্টবিনে ফেলে দেবে একটি সুন্দর জীবনকে =======? তাই বাছেতের প্রশ্ন বা উত্তর দাড়ায় বিবেকের কাঠগোড়ায়।
0 মন্তব্যসমূহ